একজন মুশফিক ও তার সোনার গ্লাভস
নিউজ ডেস্ক
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৩:৫৩ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার
ব্যাটসম্যান মুশফিক, নাকি উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিম; জাতীয় দলের জনপ্রিয় ক্রিকেটারের কোন চরিত্রটি আপনার পছন্দের ? প্রশ্নের উত্তরে ভিন্নতা আসাটা স্বাভাবিক। তবে পরিসংখ্যান ঠিকই গড়ে দিবে পার্থক্য, জানিয়ে দিবে কোন চরিত্রের রিয়েল হিরো মুশফিক।
ইতিহাস বলছে, ২০০৫ সালে অভিষিক্ত হওয়ার পর থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটে ৩৪১টি ম্যাচে অংশ নিয়েছেন মুশফিকুর রহিম। যাতে ৩১২টি ম্যাচে গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়েছেন, ক্যাচ ধরেছেন ২৮৯টি এবং তার স্ট্যাম্পিংয়ের সংখ্যা ৭৮টি। অর্থাৎ বাংলাদেশিদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ইনিংসে উইকেটের পেছনে দাঁড়ানো খেলোয়াড় মুশফিক। তার পরের অবস্থানে সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট। টেস্ট-ওয়ানডে মিলিয়ে ১৭০টি ম্যাচে দস্তানা হাতে ব্যাটসম্যানের পেছনে দাঁড়িয়েছেন তিনি। হিসেবে সফল নাকি স্রেফ ব্যাটসম্যান হিসাবে জুতসই। এক্ষেত্রে পরিসংখ্যানের দাবি, রহিম তার ক্যারিয়ারে ৬৬টি টেস্টের মাত্র ১২ ম্যাচে উইকেটের পেছনে দাঁড়াননি। যাতে তার রান এসেছে ইনিংস প্রতি ২৩ (গড়)। এছাড়া বাদ বাকি ৫৪ ম্যাচে (১০৮ ইনিংস) উইকেটের পেছনে কখনো ৯০ ওভার কিংবা তার চেয়ে কম ওভার কিপিংয়ের পর ব্যাটিং করেছেন। কিন্তু তারপরও পরিশ্রমী মুশফিকের পক্ষেই কথা বলছে ইতিহাস। এই ১০৮ ইনিংসে তার ব্যাটিং গড় ৩৮ উর্ধ্ব।
এরপর আমরা যদি একদিনের ফরম্যাট ওয়ানডে দিকে নজর দেই তবে দেখা যাবে ২০০৫ সালের পর আজ অবধি ১৯৮টি ওয়ানডে ম্যাচের ১৮৫টিতেই উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়েছেন মুশফিকুর রহিম। তাতেও সফল তিনি। ৩৩ গড়ে রান করেছেন সাড়ে চার হাজারের ওপরে। টি-টুয়েন্টিতেও একই হাল। দস্তানা বারংবার তার পক্ষেই সাফাই গেয়েছে। গ্লাভস হাতে সাড়ে এগারশ’র (১১৩৮) ওপরে রান তুলেছেন তিনি। এই কারণেই হয়তো বরাবর মুশফিকের কাছে গ্লাভস অতি লোভনীয়। গ্লাভস ছাড়া মাঠে নামার পক্ষে আপোষহীন।
এ দিকে পরিসংখ্যানে সুস্পষ্ট লিপিবদ্ধ আছে, ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটে আন্তর্জাতিক উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানদের মধ্যে বাংলাদেশি মুশফিকুর রহিমের অবস্থান ১৫তম। অর্থাৎ ২০১৫ সালে ২১ নম্বরে থাকা এই ক্রিকেটার তার র্যাঙ্কিংয়ে ৬ সংখ্যা উপরে উঠলেও ‘দ্য ক্রিক মান্থলির’ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, মুশফিক তার ক্যারিয়ারে মোট ম্যাচের প্রায় ৩২ শতাংশ ক্যাচ মিস করেছেন। হাস্যকর ব্যাপার হলো, পাকিস্তানের ‘ক্যাচ মিসের রাজা’ খ্যাত কামরান আকমলের চেয়েও তিনি চার ধাপ পিছিয়ে। আর সবমিলিয়ে দশম।
পরিসংখ্যানে এ তালিকায় সবার ওপরে দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান মার্ক বাউচার। প্রতিটি ইনিংসে তার ক্যাচ মিসের হার মাত্র ১০ শতাংশ। এর পরের স্থানটি ওয়াটলিনের। মজার ব্যাপার হলো, জিম্বাবুয়ের সাবেক অধিনায়ক টাটেন্ডা টাইবুও উইকেটের পেছনে ছিলেন দক্ষ পাহারাদার। ওয়াটলিনের মতো তারও ১১ শতাংশ ক্যাচ ছুটে যাওয়ার সম্ভবনা ছিল। অথচ তাদের সমকক্ষ (ম্যাচ সংখ্যায়) মুশফিক ১০ জনের তালিকায় সবার নিচে।
ক্যাচ মিসের পরক্ষণে যদি আমরা ডিসমিসাল নিয়ে কথা বলি, সেক্ষেত্রে মুশফিকুর রহিম তিন ফরম্যাটে ৩৬৭ ডিসমিসাল করতে সক্ষম হয়। আর সর্বোচ্চ ডিসমিসালের নায়ক সেই মার্ক বাউচারই। ইতিহাসের সর্বোচ্চ সংগ্রহ ডিসমিসাল করতে সক্ষম আফ্রিকান কিংবদন্তি। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯৭ থেকে ২০১২ অর্থাৎ এই ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে ৪৬৭ ম্যাচে অংশ নিয়ে ৯৯৮টি ডিসমিসাল করতে সক্ষম হন বাউচার। সে হিসাবে প্রতি ইনিংসে ১ দশমিক ৬৭ ডিসমিসাল করতে সক্ষম হন তিনি। যা রীতিমত অবিশ্বাস্য। বাউচারের পরের অবস্থানটি গিলক্রিস্টের। এছাড়া সেরা পাঁচে রয়েছেন এশিয়ার দুইজন ধোনি-সাঙ্গাকারা। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এক্ষেত্রেও নাজুক অবস্থানে আমাদের মুশফিকুর। পঞ্চম সর্বোচ্চ ম্যাচ (৩১২) খেলেও ডিসমিসালিতে ১৫তম এ অবস্থান তার।
একজন উইকেটরক্ষক হিসেবে, ডিসমিসাল-ক্যাচ ধরার মতো গুরুত্বপূর্ণ স্ট্যাম্পিংও। এক্ষেত্রেও নড়বড়ে অবস্থানে মুশফিকুর রহিম। ৩৪৫ ইনিংসে মাত্র ৭৮টি স্ট্যাম্পিং করতে সক্ষম হন তিনি। অথচ এক্ষেত্রে ভারতের উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান মহেন্দ্র সিং ধোনি সর্বোচ্চ ১৮৬টি স্ট্যাম্পিং করতে সক্ষম হন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কুমার সাঙ্গাকারা। ১৩৯টি স্ট্যাম্পিং করেছে ৫৯৪ ম্যাচে। ক্রিকেট বিশ্লেষকদের মতে, স্ট্যাম্পিংয়ে কেবল এগিয়ে তুলনামূলক লম্বা ক্রিকেটাররাই। সেক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে মুশফিকুর রহিম।
এতক্ষণে নিশ্চয় আমরা বুঝতে পেরেছি টেকনিক্যালি এবং টেম্পারামেন্টে মুশফিকুর রহিম দেশের সেরা ব্যাটসম্যান হলেও একজন উইকেটরক্ষ হিসাবে তার ঘাটতির কমতি নেই। কিপিংয়ে ভালো বলতে শুধুমাত্র মাঝেমধ্যে দুর্দান্ত কিছু ক্যাচ ধরাকে বুঝায় না বরং ম্যাচ প্রতি ক্যাচ ধরার সংখ্যা, হাই বাউন্স বল সহজে লুফে নেওয়া, স্পিনে যতটা সম্ভব স্ট্যাম্পের কাছে গিয়ে দাঁড়ানো কিংবা সহজ অর্থে দ্রুত গতিতে স্ট্যাম্পিংকেই বুঝায়। কিন্তু স্টাম্পিংয়ে মুশির রিফ্লেক্স তুলনামূলক স্লো হওয়ায় অনেকসময় ব্যাটসম্যান বেঁচে যায় এবং বড় ইনিংস খেলে দলকে চাপে ফেলে। যা আধুনিক ক্রিকেটের সঙ্গে বেমানান। এছাড়া অদূর ভবিষ্যতে উইকেটে পেছনে দাঁড়িয়ে বাড়তি চাপ নেওয়াটা তার ব্যাটিংয়ের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সবশেষে ছোট একটি প্রসঙ্গ টেনে লেখা শেষ করতে চাই। সেটি হচ্ছে মুশফিকুর রহিম প্রায়ই বলে থাকেন, উইকেটের পেছনে দাঁড়ানোর কারণে প্রতিপক্ষের বল তিনি ভালো পড়তে পারেন। আর তা তার জন্য বেশ উপকারে আসে। এছাড়া সবশেষ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও বলেছেন, উইকেটের পেছনে দাঁড়ানোর কারণে নিজেদের বোলারদের সাজেস্ট করতে পারেন। কিন্তু আপনারাই বলুন, যেখানে ডিসমিসালি, রান আউট না করতে পারা কিংবা ক্যাচ মিসের ছড়াছড়ি সেখানে এসব যুক্তি কতটা যুক্তিসঙ্গত? আধুনিক এবং স্মার্ট ক্রিকেটে মুশফিকের যেমন উচিত উপরে এসে ব্যাটিং করা। ঠিক তেমনই উচিত দলের বিপর্যয়ে অন্যকারও হাতে গ্লাভস তুলে দেওয়া।
