আফ্রিদি আসলেন দেখলেন জয় করলেন
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০১:৫৪ পিএম, ৭ জুলাই ২০১৯ রোববার

অসম্ভবকে সম্ভব করার মিশন ছিল পাকিস্তানের সামনে। সেমিফাইনালে যেতে হলে বাংলাদেশকে বিশাল বড় ব্যবধানে হারাতে হতো তাদের। কিন্তু পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলা বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তানের এত বিশাল ব্যবধানে জয় নেহাত পাগলের প্রলাপের মত। কিন্তু বিশাল ব্যবধানে জয় না পাক, নিজেদের কাজটা ঠিকই করেছে পাকিস্তান। বাংলাদেশকে ৯৪ রানের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে বিশ্বকাপে ৫ম হয়েই মিশন শেষ করল সরফরাজ বাহিনী।
চতুর্থ স্থানে থেকে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল নিশ্চিত করা নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে পয়েন্ট ব্যবধান এবং জয় সংখ্যা সমান হওয়ার পরেও রানরেটের গড়ে এগিয়ে থেকে কিউইরা জায়গা করে নেয় সেমিতে। পাকিস্তানের এমন দাপুটে জয়ে সবচেয়ে যিনি বেশি ভূমিকা রেখেছেন তিনি হলেহ শাহিন শাহ আফ্রিদি। সাবেক পাকিস্তানি ক্রিকেটার শহীদ আফ্রিদির মত উইকেট নেওয়ার পর উদযাপন করে থাকেন তিনি। বাংলাদেশের বিপক্ষে এক অনবদ্য বিশ্ব রেকর্ড গড়ে পাকিস্তানকে স্বস্তির জয় এনে দেন শাহিন। তার ৬ উইকেট নেওয়ার সুবাদে বিশ্বকাপের রেকর্ডের অনেক পাতাই ওলট পালট হয়ে যায়।
টস জিতে সরফরাজ পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেন। কেননা এই ম্যাচে যদি পাকিস্তান পরে ব্যাটিং করে তাহলে ওখানেই শেষ হয়ে যেত পাকিস্তানের সেমির স্বপ্ন। আগে ব্যাটিং করায় বালুর কণার মত বিন্দু পরিমাণ সম্ভাবনা টিকে ছিল পাকিস্তানের। শুরুতে দুই পাকিস্তানি ওপেনার দেখে শুনে খেলতে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশি বোলারদের মেরে খেলার মত তেমন কোন সুযোগই পাচ্ছিলেন না তারা। যার দরুন মারতে গিয়ে অষ্টম ওভারেই ফখর জামানের উইকেট হারায় পাকিস্তান। সাইফুদ্দিনের বলে মেহেদি মিরাজের হাতে ক্যাচ দিয়ে মাত্র ১৩ রান করে এবারের বিশ্বকাপ মিশন শেষ করেন তিনি।
কিন্তু দ্বিতীয় উইকেট জুটিতেই ঘুরে দাঁড়ায় পাকিস্তান। বিশ্বকাপে পাকিস্তানের সেরা ব্যাটসম্যান বাবর আজম ও ওপেনার ইমাম উল হকের ১৫৭ রানের দুর্দান্ত জুটিতে পাকিস্তান পায় বড় রান করার ভিত। ইমামের থেকে এদিন বেশি আগ্রাসী ছিলেন বাবর আজম। ৬২ বলে নিজের অর্ধশতক তুলে নেন তিনি। তখন অপর প্রান্তে মাত্র ৩৭ রান নিয়ে ব্যাট করছিলেন ইমাম উল হক। নিজের নামের পাশে ৫৫ রান হতেই বাবর আজম এক অনবদ্য মাইলফলক স্পর্শ করেন। এক বিশ্বকাপে পাকিস্তানিদের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান করার রেকর্ড গড়লেন তিনি।
২৫ ওভারে পাকিস্তানের রান গিয়ে দাঁড়ায় ১১৫। এর পরের ওভারেই ৫৭ রানে অপরাজিত বাবর আজমের ক্যাচ ফেলে দেন মোসাদ্দেক। এরপরেই মূলত পাকিস্তান রান তোলার গতি বাড়ায়। ৩০ ওভারে পাকিস্তানের রান গিয়ে দাঁড়ায় ১৬৩। সেঞ্চুরি থেকে বাবর আজম যখন মাত্র ৪ রান দূরে তখন তার কপাল পুড়ে মোহাম্মদ সাইফুদ্দিনের বলে। এই পেস বোলারের দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে এলবিডব্লিউ হয়ে ৯৬ রান করে আউট হন বাবর আজম। ৪২তম ওভারে মুস্তাফিজের বলে এক রান নিয়ে বিশ্বকাপে নিজের প্রথম সেঞ্চুরিটি করেন ইমাম উল হক। এরই সাথে ঢুকে যান লর্ডসের অনার্স বোর্ডে। যদিও এরপরের বলেই হিট আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরেন ইমাম।
ইমামের আউটের পর দ্রুতই উইকেট হারাতে থাকে পাকিস্তান। ৪৪ ওভারে পাকিস্তানের রান গিয়ে দাঁড়ায় ৫ উইকেট হারিয়ে ২৫৬। শেষ দিকে ইমাদ ওয়াসিম ২৬ বলে ৪৩ রান করলে পাকিস্তানের সংগ্রহ তিনশো পেরোয়। এই ম্যাচেও ৫ উইকেট পেয়েছেন মোস্তাফিজুর রহমান। ভারতের সঙ্গে পাঁচ উইকেটের পর পাকিস্তানের সঙ্গেও পাঁচ উইকেট পেলেন তিনি। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে টানা দুই ম্যাচে পাঁচ উইকেট পাওয়া একমাত্র বোলার মোস্তাফিজ। তাছাড়া পাঁচ উইকেট পাওয়ার মাধ্যমে ওয়ানডে ক্যারিয়ে ১০০ উইকেটের মাইলফলকও স্পর্শ করেন। বাংলাদেশের ত বটেই এশিয়ান পেস বোলারদের ভেতরেও সবচেয়ে কম ম্যাচে ওয়ানডেতে একশো উইকেট পাওয়ার রেকর্ড গড়েন মোস্তাফিজ।
৩১৬ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরুর পাঁচ ওভার দেশেশুনেই খেলে বাংলাদেশ। এরপরেই শুরু হয় ছন্দ পতন। ২২ রান করে সৌম্য সরকারকে আউট করে বাংলাদেশের প্রথম উইকেটের পতন ঘটান মোহাম্মদ আমির। এরপরের সময়টা ছিল শুধুই শাহিন আফ্রিদির। পুরো বিশ্বকাপে ফ্লপ থাকা তামিম এদিনও ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। ২৩ বল থেকে মাত্র ৮ রান করে শাহিন আফ্রিদির স্লোয়ার বলে বোল্ড হন তামিম। এরপর মুশফিক আসলে তার সঙ্গে জুটি গড়েন সাকিব। ৩০ রানের ছোট্ট জুটিতে ভাঙল ধরান ওয়াহাব রিয়াজ। মুশি ১৬ রান করে আউট হলে ক্রিজে আসে লিটন। ততক্ষণে বাংলাদেশের ৭৮ রানে নেই ৩ উইকেট। চতুর্থ উইকেট জুটিতে লিটনের সঙ্গে জুটি গড়ে ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন সাকিব। নিজের অর্ধশতক পূরণ করে এই বিশ্বকাপে ৮টি ম্যাচের ভেতর ৭টিতেই ৫০+ ইনিংস খেলার বিরল রেকর্ড গড়েন সাকিব। একমাত্র শচীন টেন্ডুলকারই এক বিশ্বকাপে এতগুলো ৫০+ স্কোর করেছিলেন।
ক্রিজে কিছুটা থিতু হওয়া লিটনও বেশ খেলছিলেন। সাকিবের সঙ্গে ৫৮ রানের জুটি গড়ার পর সেই শাহিন আফ্রিদির বলেই উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসেন লিটন দাস। এরপর ছিল শুধুই আসা যাওয়ার মিছিল। লিটন দাসের আউটের পর ক্রিজে বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি সাকিবও। ৬৪ রান করে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান করার তালিকায় সবার উপরে থেকেই বিশ্বকাপ শেষ করলেন সাকিব আল হাসান। তার উইকেটটিও নেন শাহিন আফ্রিদি। শেষ দিকে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, সাইফুদ্দিন ও মোস্তাফিজের উইকেট নিয়ে বিশ্বকাপে প্রথম পাকিস্তানি হিসেবে ৬ উইকেট পাওয়ার রেকর্ড গড়েন শাহিন আফ্রিদি।
কিন্তু সবার নজর কেড়েছে যেই রেকর্ডটি সেটি হল, বিশ্বকাপে সবচেয়ে কম বয়সী বোলার হিসেবে ৫ উইকেট নেওয়ার নজির স্থাপন করলেন ১৯ বছর বয়সী এই পেস বোলার। তাছাড়া বিশ্বকাপে নিয়েছেন ১৬টি উইকেট। যার মাত্র ৩টি ছিল টেল অন্ডারের ব্যাটসম্যানদের উইকেট। এই ম্যাচে বা হাতি পেস বোলাররা মিলিয়ে নিয়েছেন মোট ১৩টি উইকেট। যা ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে এক ম্যাচে বা হাতি পেস বোলারদের নেয়া সর্বোচ্চ উইকেটের নজির।
ম্যান অফ দ্য ম্যাচ পুরস্কার পাওয়া শাহিন আফ্রিদি পুরস্কার নিতে এসে বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ। বোলিং কোচ আজহার মেহমুদ আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন এবং আমি আমার পারফরম্যান্সে খুশি। এটা আমার, আমার পরিবার এবং পাকিস্তানের জন্য বিশেষ এক অনুভূতি। যখনই অভিজ্ঞরা আমাকে ইয়োর্কার দিতে বলত, আমি চেষ্টা করতাম দিতে। তাদের অভিজ্ঞতা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। এটা অনেক স্লো উইকেট ছিল। আমি প্রথম ইনিংসে মোস্তার কাটার দেখেছি, আমিও তার মত করার চেষ্টা করেছি। এই এওয়ার্ডটি আমি আমার আব্বাকে উৎসর্গ করলাম।’।