রোহিতের ভাগ্যে পাওয়া সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশের বিদায়
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ১০:০৫ এএম, ৩ জুলাই ২০১৯ বুধবার

নয় রানে রোহিত শর্মার ক্যাচ ফেলে দেয়ার পর ইয়ান বিশপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, তামিম ইকবাল এ কী করলেন আপনি! আপনি তো ক্যাচ নয়, পুরো ম্যাচটাই ফেলে দিলেন; সত্যি সত্যিই তামিম ওই ক্যাচটা মিস করে ম্যাচটাকেই ছেড়ে দিয়েছেন। মাত্র নয় রানে জীবন পাওয়া রোহিত শর্মা ইনিংস শেষ করেন ১০৪ রান করে। মূলত তার ওই ইনিংসটার কাছেই হেরে বসে বাংলাদেশ।
মজার ছলে চাইলে বলা যায়, যারা দীর্ঘদিন কোনো সাফল্য পাচ্ছেন না কিংবা ভাগ্যের দোহাই দিয়ে কোনো কাজ করতে পারছেন না তারা চাইলে দ্রুতই রোহিত শর্মার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। একটা খেলোয়াড় কতটা ভাগ্যবান হলে বিশ্বকাপে চারটি ম্যাচে মাত্র ১০ রানের নিচে চারবার জীবন পেলে সেটিকে সেঞ্চুরি কিংবা হাফ সেঞ্চুরিতে রূপান্তর করতে পারে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হচ্ছেন রোহিত শর্মা।
বাংলাদেশের বাঁচা মরার ম্যাচে টাইগারদের কোনো ছাড় না দিয়ে তুলে নিয়েছেন সেঞ্চুরি। তার সেঞ্চুরির কল্যাণেই ভারত পায় তিনশ’র বেশি রান করার ভিত। আর সেটিকে টপকাতে গিয়ে বিশ্বকাপের স্বপ্ন জলাঞ্জলি দেয় বাংলাদেশ। ব্যাট হাতে লড়াই করে হারলেও বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের দৃষ্টিকটু শট বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে পুরো ম্যাচ জুড়েই। বল হাতে বোলাররা শেষ দিকে দারুণ বল করলেও শুরুর দিকে একদমই ছিলেন নখদর্পহীন। রোহিত শর্মাকে ৯ রানে জীবন দিয়ে তামিম ইকবাল তাকে সুযোগ করে দেন বড় রান করার। সেই সুযোগকে বেশ ভালোভাবে কাজে লাগিয়েই এক বিশ্বকাপে দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে তুলে নেন চারটি সেঞ্চুরি।
রোহিত শর্মা বিরাট কোহলির বদান্যতায় নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতে পারেন। কেননা, গুরুত্বপূর্ণ টস জিতে শুরুতেই ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেন বিরাট কোহলি। এমন ব্যবহৃত উইকেটে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত যে একদমই ভুল ছিল না সেটিকে প্রমাণ করেন ভারতীয় দুই ওপেনার লোকেশ রাহুল ও রোহিত শর্মা।
মাশরাফীর প্রথম ওভারে ১০ রান নিয়ে উড়ন্ত সূচনা পায় ভারত। ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিংয়ের ধার দেখে তৃতীয় ওভারেই মোস্তাফিজকে বোলিংয়ে আনেন মাশরাফি। মোস্তাফিজের দ্বিতীয় ওভারের চতুর্থ বলে ম্যাচের সবচেয়ে বাজে কাজটিই করেন তামিম ইকবাল। মোস্তাফিজের করা শর্ট বলে রোহিত শর্মা পুল করে ডিপ স্কয়ার লেগ দিয়ে উড়িয়ে চার মারতে গেলে তা সরাসরি এসে পড়ে তামিমের হাতে কিন্তু তামিম ইকবাল সেই সহজ ক্যাচটি লুফে নিতে ব্যর্থ হন। তার এমন ব্যর্থতায় পুরো দলই মাটিতে নেমে যায়।
ক্যাচ মিসের পর শুরু হয় রোহিত ও রাহুল তাণ্ডব। প্রথম দশ ওভারে কোন উইকেট না হারিয়ে ৬৯ রান তুলে ফেলে ভারত যা বিশ্বকাপে তাদের প্রথম পাওয়ার প্লে তে সর্বোচ্চ রান। মাঝে সাকিব কিছুটা রান চাপিয়ে রাখলেও অন্য বোলারদের সমানে বাউন্ডারি ও ওভার বাউন্ডারি হাঁকাতে থাকেন দুই ওপেনার। মাত্র ১৮তম ওভারে দলের রান একশো পার করেন এই দুজন। এর আগে নিজের অর্ধশতক পূরণ করেন রোহিত মাত্র ৪৫ বলে। রোহিতের পরেই বিশ্বকাপে নিজের প্রথম অর্ধশতক তুলে নেন লোকেশ রাহুলও। ২৪তম ওভারে মোস্তাফিজকে ছক্কা হাঁকিয়ে দলের রান দেড়শো পার করেন রোহিত।
একটা পর্যায়ে মনে হচ্ছিল ভারত সম্ভবত ৩৫০ এর বেশি রান করতে যাচ্ছে। ২৯তম ওভারে সাকিব আল হাসানের বলে সিঙ্গেলস নিয়ে তুলে নেন এবারের বিশ্বকাপে নিজের চতুর্থ সেঞ্চুরি। প্রথম ভারতীয় ক্রিকেটার হিসেবে এক বিশ্বকাপে চারটি সেঞ্চুরি করার রেকর্ড গড়লেন রোহিত। এর আগে সৌরভ গাঙ্গুলি ২০০৩ বিশ্বকাপে তিনটি সেঞ্চুরি করেছিলেন। তাছাড়া দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে কুমার সাঙ্গাকারার পর এক বিশ্বকাপে চারটি সেঞ্চুরি করলেন রোহিত শর্মা।
রেকর্ড গড়ার পরের বলে চার মারেন রোহিত শর্মা। কিন্তু এর পরের বলেই লিটন দাসের কাছে ক্যাচ দিয়ে সৌম্যের বলে ১০৪ রানের ইতি টানেন এই মারকুটে ওপেনার। এক বিশ্বকাপে ভারতীয়দের সবচেয়ে বেশি রান করার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসলেন রোহিত। তার রান এবারের বিশ্বকাপে ৫৪৪। ২০০৩ বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ৬৭৩ রান করেছিলেন শচীন টেন্ডুলকার যা এখনো পর্যন্ত রেকর্ড। শচীন টেন্ডুলকার বিশ্বকাপে ৬ সেঞ্চুরি করতে যেখানে খেলেছেন ৪৪ ইনিংস সেখানে রোহিত শর্মা সবমিলিয়ে বিশ্বকাপে মোট ৫ সেঞ্চুরি করতে খেলেছেন মাত্র ১৫ ইনিংস।
এছাড়া বার্মিংহ্যাম মাঠটাও তার কাছে বেশ প্রিয়। টানা তিন ম্যাচ খেলে বার্মিংহ্যামে তিনটিতেই সেঞ্চুরি করেছেন রোহিত। ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে এ মাঠে বাংলাদেশের বিপক্ষে করেছিলেন ১২৩ রান, এ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করেছেন ১০২ রান এবং আজ বাংলাদেশের বিপক্ষে করেছেন ১০৪ রান। ইংল্যান্ডের কোন মাঠে সেঞ্চুরির হ্যাটট্রিক করে একমাত্র ব্যাটসম্যান হলেন রোহিত শর্মা।
জেসন রয়ের সঙ্গে যৌথভাবে ইংল্যান্ডের মাটিতে ৬টি সেঞ্চুরি করে রোহিত শর্মা উঠে এসেছেন দুই নম্বরে। ইংল্যান্ডের মাটিতে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি রয়েছে কেবল মার্কস ট্রেসকথিক ও জো রুটের ৮টি করে। ২০১৭ সালের পর ক্রিকেটটাকে আবার নতুন করে শিখাচ্ছেন রোহিত শর্মা। এই দেড় বছরে তিনি করেছেন টোটাল ১৬টি সেঞ্চুরি। যেখানে পুরো বাংলাদেশ দল মিলেই করেছে ১৬টি সেঞ্চুরি এ সময়ে।
১৮০ রানের উদ্বোধনী জুটি ভেঙ্গে রোহিত শর্মার আউটের পরেই ফাটল ধরে ভারতীয় ইনিংসে। এরপর দ্রুতই লোকেশ রাহুল রুবেলের বলে আউট হন ৭৭ রান করে। ৩৯তম ওভারে ডাবল উইকেট মেডেন নিয়ে অনন্য নজির গড়েন বাংলাদেশের পেসার মোস্তাফিজুর রহমান। ওই ওভারের দ্বিতীয় বলে বিরাট কোহলিকে আউট করেন তিনি। চতুর্থ বলে আউট করেন হার্ড হিটার হার্দিক পান্ডিয়াকে। স্লিপে পান্ডিয়া ক্যাচ দেন সৌম্য সরকারকে। তবে শেষ দিকে রিশভ পান্ট ভালোই ব্যাট চালান। ৪১ বলে ৪৮ রান করে তিনি সাকিবের এবারের বিশ্বকাপে ১১তম শিকারে পরিণত হন।
শেষ ওভারটা মোস্তাফিজের জীবনে স্মরণীয় একটি ওভার হয়ে থাকবে। ওই ওভারে তিনি মাত্র ২ রান দিয়ে নেন ২টি মূল্যবান উইকেট। প্রথমে আউট করেন ধোনিকে। পঞ্চম বলে ভুবনেশ্বর কুমার রান আউট হন। শেষ বলে তিনি মোহাম্মদ শামীকে বোল্ড করেন। বিশ্বকাপে সাকিব আল হাসানের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে পাঁচ উইকেট নেয়ার অনন্য নজির স্থাপন করলেন মোস্তাফিজ।
৩১৫ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরুতে সাবধানী সূচনা করলেও প্রথম পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে আউট হন তামিম ইকবাল। এরপর নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে বাংলাদেশ। একমাত্র সাকিব আল হাসানের ৬৬ রান ছাড়া মিডল অর্ডারে আর কেউই বড় রান করতে পারেননি। শেষ দিকে সাব্বির রহমান ৩৬ ও সাইফুদ্দিন বীরোচিত অপরাজিত ৫১ রান কেবল হারের ব্যবধানই কমিয়েছে। দুই ওভার বাকি থাকতেই বাংলাদেশ অলআউট হয়ে যায় ২৮৬ রানে।
এক বিশ্বকাপ তিনবার ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হওয়া রোহিত শর্মা পুরস্কার নিতে এসে বলেন, আমি প্রথম থেকেই দারুণ অনুভব করছিলাম। ব্যাট করার জন্য পিচটি একদম উপযোগী। প্রথম দিকে কিছুটা সময় নিতে চাচ্ছিলাম। এরপর আসলে যা ঘটেছে তা পুরো বিশ্বকাপে আমার জন্য ঘটেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচটা কিছুটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটায় উইকেটের গতি অনেক ছিল এবং পেস সহায়ক ছিল। কিন্তু প্রথমে ব্যাট করার সুবিধাই হলো কোনো চাপ থাকে না।
রোহিত শর্মা বলেন, আমি কিছুটা ভাগ্যবান বলা যায়। সৌভাগ্যই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। আমি ছোট বাউন্ডারি নিয়ে একবারো ভাবিনি। আমার চিন্তাই ছিল বোলারদের উপর এবং ফিল্ডারদের উপর কীভাবে চাপ সৃষ্টি করা যায় সেটা নিয়ে ভাবা। আমার লক্ষ্য ছিল অতীতে যাই হোক না কেন, সেগুলো অতীতেই চলে গেছে। একটা নতুন দিনে শুধু বর্তমানকে নিয়ে চিন্তা করা। অতীতে কী হয়েছে সেটা নিয়ে একদম ভাবি না আমি। উইকেটে সেট হওয়ার পর বড় স্কোর করার পর আউট হয়ে যাওয়াটা দলের জন্য সংকটপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি করে। আজকে যা হয়েছে সেটা হয়েই গেছে। পরবর্তী ম্যাচে আমাদের নজর দেয়া উচিত।