রোববার   ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫   আশ্বিন ৫ ১৪৩২   ২৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করুন : ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন

নিউজ ডেস্ক

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৭:০৪ পিএম, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ মঙ্গলবার

ছোটোবেলা থেকেই মিষ্টির প্রতি প্রচÐ আগ্রহ সাজিদের। মিষ্টি পেলেই গোগ্রাসে খেত। একবার বন্ধুদের সাথে বাজি লেগে একা এককেজি মিষ্টি খেয়ে ফেলে। শর্ত ছিল খেতে পারলে এককেজি মিষ্টি ফ্রি, সাথে অতিরিক্ত ৫০ টাকা পাওয়া যাবে। ফাও মিষ্টির সাথে বাড়তি আরও ৫০ টাকা তখন ছাত্র অবস্থায় কম নয়। এভাবে দিন পার হয়ে যাচ্ছিল তার।

সাজিদের পরিবারের অনেকেই ডায়াবেটিস রোগী। তার মায়েরও ডায়াবেটিস ছিল এটা সে খেয়াল করেনি। বয়স বাড়লেও মিষ্টির প্রতি আগ্রহ খুব সাজিদের। একদিন হঠাৎ খেয়াল করে যে তার ওজন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। শরীর দুর্বল লাগে, মাথা ঝিম ঝিম করে। সে বুঝতে পারে না কেন এমন হচ্ছে। অবশেষে আত্মীয়স্বজনের পরামর্শে সে স্থানীয় ডায়াবেটিক সেন্টারে রক্ত পরীক্ষার জন্য যায়। ডাক্তার রক্তের জিটিটি পরীক্ষা (গøুকোজ টলারেন্স টেস্ট) করে আঁতকে ওঠেন। খাওয়ার আগেই তার বøাড গøুকোজ লেভেল ১৯ এর ওপরে। বংশগত কারণ আর অনিয়ন্ত্রীত খাওয়া দাওয়ায় তার এ অবস্থা। এটা জেনে সাজিদ খুব ভয় পায়। ডাক্তারদের পরামর্শ, নিজের চেষ্টা ও পরিবারের নিবিড় পরিচর্যায় তাঁর ডায়াবেটিস একসময় নিয়ন্ত্রণে আসে। এখন সে মিষ্টি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলে। নিয়মমাফিক ঔষধ খায়, হাঁটাহাঁটি ও কায়িক পরিশ্রম করে, বেশ সুস্থ আছে।

সাজিদ ভাগ্যবান, কারণ দেরিতে হলেও তার ডায়াবেটিস শনাক্ত হয়েছিল, এবং নিয়ম মেনে চলায় বর্তমানে ভালো আছে। কিন্তু বাংলাদেশে এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা সাজিদের মতো নয়। তাদের ক্ষেত্রে হয়তো যথাযথ সময়ে স্ক্রিনিং করতে না পারায় ডায়াবেটিস সময়মতো শনাক্ত হয়নি। ফলে, মারাত্মক ডায়াবেটিস নিয়ে শরীরে নানা ধরনের জটিল রোগ তৈরি করে ও যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছে।

বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হলো বিশ্ব জুড়ে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি অভিযান, যা প্রতিবছর ১৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস রোগ ব্যাপকহারে বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ব ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯১ সাল এ ১৪ নভেম্বরকে ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য "ঞযব ভধসরষু ধহফ ফরধনবঃবং"।

সুস্বাস্থ্য সুস্থ জীবনের প্রতীক। ডায়াবেটিস রোগ বিষয়ে সচেতনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সামগ্রিকতা চিন্তা করলে সুস্বাস্থ্যের অভাবে দেশের উৎপাদনশীলতা কমে যায় এবং এটি উন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায়। এজন্য সরকার দেশব্যাপী স্বাস্থ্য অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় ডাক্তার ও নার্স নিয়োগসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে পর্যাপ্ত উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে বিভিন্ন অসংক্রামক ব্যাধিসহ ডায়াবেটিক রোগ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। এ জটিলতায় বাংলাদেশে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের ঝুঁকি দিনে দিনে বাড়ছে।

ডায়াবেটিস রোগের আরেক নাম বহুমূত্র রোগ। দেহের অভ্যন্তরে অগ্ন্যাশয় যথেষ্ট পরিমাণে ইনসুলিন তৈরি করতে না পারলে এ রোগ হতে পারে। বহুমূত্র রোগ হলে রক্তে চিনি বা শর্করার পরিমাণের অসামঞ্জস্য অবস্থা তৈরি হয় এবং ইনসুলিনের ঘাটতিতেই রোগটি হয়ে থাকে। ডায়াবেটিস রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে ভালো থাকা যায়। অবহেলায় জটিলতা দেখা দিলে দেহে নানা রকম জটিলতা দেখা দেয়।

আমাদের শরীরে সাধারণত গøুকোজের পরিমাণ ৩.৩ থেকে ৬.৯ মিলি. মোল/লি. থাকে। খালি পেটে যদি ৭ মিলি. মোল/লি. এবং খাবার গ্রহণের পর ১১ এর বেশি থাকে তবে ডায়াবেটিস রোগ আছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

ডায়াবেটিস রোগটি যে-কোনো বয়সের মানুষের হতে পারে। এ রোগে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য প্রতীয়মান থাকে যেমন- ঘন ঘন প্র¯্রাব হওয়া, মুখ ও গলা শুকিয়ে যাওয়া; দুর্বলতা, ক্ষুধা লাগা, ওজন কমে যাওয়া, কিডনি, চোখসহ দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে জটিলতা দেখা দিতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীর শারীরিক জটিলতা অনেক তবে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। স্বাস্থ্যসম্মত জীবনাচরণের মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রেখে কর্মমুখর জীবনযাপন সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তা বোঝার উপায় কি? রক্তে গøুকোজমাত্রা খালিপেটে ৬.১ মিলিমোল/ লিটার এবং আহারের ২ ঘণ্টা পরে ৮ মিলিমোল/ লিটার হলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরে নেয়া হয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থ্রিজি ফরমুলা অনুসরণ করা যায়। থ্রিডি মানে ত্রিমাত্রিক বা থ্রি ডাইমেনশনাল কোনো বিষয় নয়। এটি হলো ডায়েট, ড্রাগ ও ডিসিপ্লিন, অর্থাৎ পরিমিত আহার, নিয়মিত ঔষধ সেবন ও  সুশৃঙ্খল, শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন অতিবাহিত করা।

শৃঙ্খলা হলো ডায়াবেটিস রোগের মূল কথা। একজন ডায়াবেটিস রোগীকে জীবনে সকলক্ষেত্রে শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। তবে কিছু বিষয়ের ওপর বিশেষভাবে নজর রাখতে হবে। নিয়মিত ও পরিমিত সুষম খাবার খাওয়া, পরিমিত দৈহিক পরিশ্রম, নিয়মিত ঔষধ সেবন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, পায়ের যতœ নেয়া, মিষ্টি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার সম্পূর্ণ পরিহার করা, শারীরিক কোনো সমস্যা দেখা দিলে জরুরিভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া রোগের চিকিৎসা বন্ধ না রাখা। মনে রাখতে হবে ডায়াবেটিস রোগ শনাক্ত হওয়ার পর নিয়মকানুনের মধ্যে দিন অতিবাহিত করার কারণে কোনোও জটিলতা ছাড়াই একজন মানুষ সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে।

-২-

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শুধু বাংলাদেশ নয় বর্তমান বিশ্বের সর্বাপেক্ষা গুরুতর ব্যাধিগুলোর মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে সারা পৃথিবীতে ৩৫ কোটি মানুষ ডায়াবেটিস রোগে ভুগছে। শুধু ডায়াবেটিস রোগের কারণে ২০১২ সালে সারাবিশ্বে ১৫ লক্ষ মানুষ মারা গেছে। ডায়াবেটিসে মৃত্যুর শতকরা ৮০ ভাগ হয় নি¤œ ও মধ্য আয়ের দেশসমূহে। আশংকা করা হচ্ছে যে, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুর সপ্তম কারণ হবে ডায়াবেটিস। বিশ্বে প্রতি ১০ সেকেÐে একজন ডায়াবেটিসের কারণে মৃত্যুবরণ করে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন’ (আইডিএফ) এর তথ্যমতে, দেশে মোট ৭১ লাখ শনাক্তকৃত ডায়াবেটিস রোগী। এছাড়া আরও প্রায় ৭১ লাখ (মোট প্রায় ১ কোটি ৪২ লাখ) মানুষ ডায়াবেটিস নিয়ে বসবাস করছে যারা এখনও পর্যন্ত শনাক্ত হয়নি। ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪২.৫ কোটি। ডায়াবেটিস এর ভয়াবহতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মৃত্যুর হারও বৃদ্ধি পেয়েছে।

শরীরে প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত ইনসুলিন নিঃসরণ ও ইনসুলিনের কার্যকারিতা হ্রাস ডায়াবেটিস রোগের কারণ। ডায়াবেটিস প্রধানত দু’ধরনের। একটি টাইপ-১ ও অপরটি টাইপ-২। টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের শরীরে কোনো ইনসুলিন তৈরি হয় না। ফলে তাদের জীবনভর ইনসুলিন নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। অপরদিকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস এর ক্ষেত্রে শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না অথবা শরীরে তৈরি ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না। ফলে যাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস আছে তাদের প্রায়ই ঔষধ খেতে হয় অথবা ইনসুলিন নিতে হয়। প্রথমটির ক্ষেত্রে এই ধরনের রোগীর দেহে ইনসুলিন একেবারেই তৈরি হয় না। সাধারণত ৩০ বছরের কম বয়সে এটি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে রোগীর শরীর ক্রামান্বয়ে শুকিয়ে যেতে পারে এবং ইনসুলিন নিতেই হয়। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে ৩০ বছরের বেশি বয়সে এ রোগ হতে পারে, এ রোগীর ক্ষেত্রে দেহে ইনসুলিন তৈরি হলেও অপর্যাপ্ত, তবে এ ধরনের রোগীর সবসময়ই ইনসুলিন নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা থাকে না। ব্যায়াম, উপযুক্ত খাদ্যাভ্যাস, নিয়মমাফিক প্রাত্যহিক জীবনযাপনে নিয়ন্ত্রণে থাকা সম্ভব।

অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে মানুষ পাক্ষাঘাত, হৃদরোগ, চক্ষুরোগ, পঁচনশীল ক্ষত, মাড়ির প্রদাহ, অ্যাকজিমা, মুত্রাশয়ের রোগ, কিডনি জটিলতাসহ নানা ধরনের রোগ হতে পারে। বর্তমান বিশ্বে ডায়াবেটিস নিঃসন্দেহে মারাত্মক তবে ছোঁয়াচে নয়। আগে একসময় ঘন ঘন প্র¯্রাব হলে ডায়াবেটিস হয়েছে বলে ধরে নেয়া হতো। গবেষণায় এটি ভুল প্রমাণিত। কেবল রক্তে গøুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করেই রোগ শনাক্ত করা সম্ভব। ডায়াবেটিস রোগীর দেহে যে-কোনো ক্ষত শুকাতে সময় লাগে। সবচেয়ে বেশি ক্ষত হয় পায়ে। ডায়াবেটিস রোগীর ব্রেইন স্ট্রোক হয়, কিডনি, চোখ ইত্যাদি অঙ্গের ক্ষতি হয় তবে পায়ের যতœ করতে হয় বেশি, কারণ পচন শুকাতে দেরি হয় বলে সাধারণ মানুষের তুলনায় পা কেটে ফেলার প্রবণতা থাকে বেশি। রক্তে গøুকোজের পরিমাণের তারতম্যে ডায়াবেটিস কম-বেশি হয়। খুব বাড়লে হাইপার এবং কমে গেলে হাইপো বলা হয়। দুটোই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতি।

ডায়াবেটিস আজীবনের রোগ। তবে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এটি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এ সঠিক ব্যবস্থাগুলো রোগীর অবশ্যই মেনে চলা প্রয়োজন। তবে রোগী এবং রোগীর স্বজনদের সচেতনতা ও দায়িত্বশীল আচরণ এ বিষয়ে অনেক সাহায্য করতে পারে। সে কারণে এ রোগের নিয়ন্ত্রণ ও সুচিকিৎসার জন্য ডায়াবেটিস সম্পর্কে রোগীর যেমন শিক্ষা প্রয়োজন তেমনি রোগীর নিকটাত্মীয়দেরও যথাযথ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। এটি সম্ভব হলে রোগী ও তার পরিবার উভয়েই একটি সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপনে সক্ষম হবেন। এবারের বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসে এটি হোক আমাদের সকলের অঙ্গীকার।
সেলিনা আক্তার
পিআইডি প্রবন্ধ