চার’শ বছরে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০১:৫৬ পিএম, ৪ মে ২০১৯ শনিবার
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ছোট-বড় ঘূর্ণিঝড় ৪’শ ৩৬ বছরে কমবেশি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আঘাত করে। তার মধ্যে ১৯৬০ সালে ভোলা ঘূর্ণিঝড়টি ছিল ইতিহাসের ভয়ংকর ও ব্যাপক বিধ্বংসী। ওই ঝড়ে প্রায় পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়া ১৫৮২ সালে টানা পাঁচ ঘণ্টার হারিকেন ও বজ্রপাতসহ ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় দুই লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। এরপর ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে আরেকটি ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়। এতে এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ নিহত হয়। ৪’শ ৩৭ বছরের ঘূর্ণিঝড়ের চিত্র তুলে ধরা হলো-
১৫৮২ সালে টানা পাঁচ ঘণ্টার হারিকেন ও বজ্রপাতসহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে পটুয়াখালীর বাকেরগঞ্জের নিকটবর্তী উপকূলীয় এলাকায়। এতে মৃত্যু হয় প্রায় দুই লাখ মানুষের। ধ্বংস হয় ঘর ও নৌকা। শুধুমাত্র শক্ত ভিতের ওপর গড়া ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো রক্ষা পায়।
১৫৮৫ সালে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় মেঘনা নদীর মোহনায় সেই বাকেরগঞ্জের পূর্বদিকে আঘাত হানে। এতে বিনষ্ট হয় ক্ষেতের ফসল। তবে প্রাণহাণির তথ্য পাওয়া যায়নি।
১৬৯৯ সালে সুন্দরবন উপকূল দিয়ে বয়ে যায় তীব্র ঘূর্ণিঝড়। তবে এতে প্রাণহাণির ছিল একেবারেই কম। বনের ক্ষতি হয় বেশি।
১৭৬০ সালে ফের সুন্দরবন উপকূলে আঘাত হানে তীব্র ঘূর্ণিঝড়। এবার প্রাণহাণি বা অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি তেমনটা না হলেও প্রায় সম্পূর্ণ এলাকাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
১৭৬৫ সালে চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত করে বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়। ক্ষতিগ্রস্থ হয় পুরো চট্টগ্রাম।
১৭৬৭ সালে ফের বাকেরগঞ্জ উপকূলে আঘাত হানে তীব্র ঘূর্ণিঝড়। ঝড়ে সাগরে ঢেউয়ের উচ্চতা ছিল ১৩.০৩ মিটার (৪৩ ফিট)। ক্ষয়ক্ষতি ছিল ব্যাপক। মারা যায় প্রায় ৩০ হাজার মানুষ।
১৭৯৭ সালের নভেম্বরে তীব্র ঘূর্ণিঝডড়ে লন্ডভন্ড হয় চট্টগ্রাম। ধ্বংস হয় ঘরবাড়ি ও গাছপালা। চট্টগ্রাম বন্দরে ডুবে যায় দুটি জাহাজ।
১৮২২ সালের মে মাসে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, হাতিয়া দ্বীপ ও নোয়াখালীতে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়। সাগরে উত্তাল ঢেউ আর জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। গাছপালা, ঘরবাড়িসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় গবাদি পশুর। প্রায় ৪০ হাজার মানুষের প্রাণহাণি ঘটে।
১৮৩১ সালের অক্টোবরে মাঝারি আকারের একটি ঝড় আঘাত করে দক্ষিণাঞ্চল বরিশালে। ১৮৭২ সালের অক্টোবরে কক্সবাজারে আঘাত করে ঘূর্ণিঝড়।
১৮৭৬ সালের ৩১ অক্টোবর ফের বড় মাত্রার ঘূর্ণিঝড় আঘাত করে বাকেরগঞ্জে। ১২.২ মিটার (৪০ ফিট) উচ্চু জলোচ্ছাস ও তীব্র ঝড় আঘাত হানে মেঘনা মোহনার চট্টগ্রাম, বরিশাল এবং নোয়াখালী জেলায়। এতে ক্ষয়ক্ষতি হয় আনুমানিক দুই লাখ মানুষের। ঝড়ের ফলশ্রুতিতে মহামারি ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। বিনষ্ট হয় প্রচুর সম্পদ।
১৮৯৭ সালের ২৪ অক্টোবর ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে তীব্র স্রোত ও ঝড়ো হাওয়াসহ শক্ত আঘাত হানে চট্টগ্রাম অঞ্চলে। বড় ধরনের আঘাত হয় কুতুবদিয়া দ্বীপে। প্রায় ১৪ হাজার মানুষ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন। ফলশ্রুতিতে মহামারি আকার ধারণ করে কলেরা। মারা যান ১৮ হাজার অধিবাসী।
১৮৯৮ সালের মে মাসে টেকনাফে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে আঘাত হানে তীব্র স্রোত। তলিয়ে যায় ব্যাপক এলাকা। ক্ষয়ক্ষতি হয় মৎস্য আহরণ।
১৯০৪ সালের নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে সোনাদিয়ায়। এতে ১৪৩ জন মানুষ ও প্রচুর মাছ ধরা নৌকা ডুবে যায়।
১৯০৯ সালের ১৬ অক্টোবর ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে তীব্র স্রোতে তলিয়ে যায় খুলনা। ক্ষয়ক্ষতি হয় ৬৯৮ জন অধিবাসীর। ৭০ হাজার ৬৫৪ গবাদিপশুর মৃত্যু হয়।
১৯১৩ সালের অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। ভূমির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় পুরো মুক্তাগাছা গ্রাম। ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন প্রায় ৫’শ অধিবাসী।
১৯১৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ঘূর্ণিঝডড়ের আঘাতে লন্ডভন্ড হয় খুলনা। ২৮ হাজারেরও বেশি গবাদি পশু মারা যায়। ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন ৪৩২ জন অধিবাসী।
১৯৪১ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে তীব্র স্রোতে তলিয়ে যায় মেঘনা নদীর পূর্ব মোহনা।
১৯৪২ সালের অক্টোবরে তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় সুন্দরবন।
১৯৪৮ সালের ১৭-১৯ মে টানা তিন দিন ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী মধ্যবর্তী ব-দ্বীপে। এতে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন আনুমানিক ১২ হাজার অধিবাসী। মারা যায় ২০ হাজার গবাদিপশু।
১৯৫৮ সালের ১৬-১৯ মে বিচ্ছিন্নভাবে মেঘনা নদীর পূর্ব পশ্চিম মোহনার পূর্ব বরিশাল ও নোয়াখালীতে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ও তীব্র স্রোত। ক্ষয়ক্ষতি হয় ৮৭০ জন অধিবাসী। প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার গবাদিপশু মারা যায়। বিনষ্ট হয় ক্ষেতের ফসল।
১৯৫৮ সালে ফের আঘাত হানে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়। ওই বছর ২১-২৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড়। এর প্রভাবে আনুমানিক এক লাখ পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে।
১৯৬০ সালের ৯-১০ অক্টোবর তীব্র ঘূর্ণিঝড় পূর্ব মেঘনা নদীর মোহনার নিকটবর্তী নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর ও পটুয়াখালীতে আঘাত হানে। তখন ঝড়ো হাওয়ার তীব্রতা ছিল ঘণ্টায় ২০১ কিলোমিটার পর্যন্ত। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ৩.০৫ মিটার। ব্যাপকভাবে বিধ্বস্ত হয় চর জব্বার, চর আমিনা, চর ভাটিয়া, রামগাতি, হাতিয়া ও নোয়াখালী। এতে প্রায় তিন হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়া ঝড়ের প্রভাবে ব্যাপক পরিমাণ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। নয় হাজার ৪শ একর জমির ফসল বিনষ্ট হয়।
১৯৬০ সালের ৩০-৩১ অক্টোবর ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার গতির তীব্র ঝড়ো বাতাসসহ প্রবল ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বাকেরগঞ্জ, ফরিদপুর, পটুয়াখালী এবং পূর্ব মেঘনা মোহনায়। ঝড়ের প্রভাবে ৪.৫-৬.১ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। এতে প্রায় ১০ হাজার অধিবাসী ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন। ২৭,৭৯৩টি গবাদিপশু মারা যায়। সাড়ে পাঁচ লাখেরও বেশি ঘরবাড়ি বিনষ্ট হয়। এরমধ্যে শুধু হাতিয়ায় শতকরা ৭০ ভাগ বাড়িঘর বিনষ্ট হয়। এছাড়া দুটি সমুদ্রগামী জাহাজ তীরে উঠে যায়। কর্ণফুলী নদীতে ডুবে যায় ৫-৭টি বড় নৌকা।
১৯৬১ সালের ৯ মে তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে বাগেরহাট ও খুলনায়। এতে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার। ঝড়ের প্রভাবে আড়াই থেকে সাড়ে তিন ফিটের বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন প্রায় সাড়ে ১১ হাজার অধিবাসী, যার অধিকাংশ চর আলেক্সজান্দারের মানুষ। ২৫ হাজার গবাদিপশু মারা যায়। ঝড়ের প্রভাবে নোয়াখালী থেকে হরিনারায়নপুর পর্যন্ত রেলপথের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
১৯৬২ সালের ২৬ থেকে ৩০ অক্টোবর তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে ফেনীতে। ওই ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার। ঝড়ের প্রভাবে আড়াই থেকে তিন মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। আনুমানিক ১ হাজারেরও বেশি অধিবাসী ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন। মারা যায় অসংখ্য গৃহপালিত পশু।
১৯৬৩ সালের ২৮ থেকে ২৯ মে তীব্র ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত করে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার, সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, হাতিয়া এবং মহেশখালী উপকূলীয় অঞ্চল। এর প্রভাবে চট্টগ্রামে সাড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৫ মিটার উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস। ওই ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২০৩ কিলোমিটার। যা কক্সবাজারে ছিল ঘণ্টায় ১৬৪ কিলোমিটার। প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মানুষের ক্ষয়ক্ষতি হয়। সাড়ে ৩২ হাজারেরও বেশি গবাদি পশু মারা যায়। এর প্রভাবে প্রায় ৩ লাখেরও বেশি ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। বিনষ্ট হয় ৪,৭৮৭টি নৌকা এবং ব্যাপক পরিমাণ জমির ফসল।
১৯৬৫ সালের ১১-১২ মে তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে বারিশাল ও বাকেরগঞ্জে। এতে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬২ কিলোমিটার। সাড়ে ৩ মিটারের বেশি জলোচ্ছ্বাস হয়। ১৯ হাজারের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়, এরমধ্যে বরিশালেই ছিল সাড়ে ১৬ হাজারের মতো।
১৯৬৫ সালের ১৪ থেকে ১৫ ডিসেম্বর তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে কক্সবাজার ও পটুয়াখালীর নিকটবর্তী উপকূলীয় অঞ্চলে। এর প্রভাবে জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায় ৪.৭-৬.১ মিটার পর্যন্ত। কক্সবাজারে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার। ৮৭৩ জন অধিবাসীর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ৪০ হাজার লবণের মাঠ বিনষ্ট হয়।
১৯৬৬ সালের ১ অক্টোর তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে সন্দ্বীপ, বাকেরগঞ্জ, খুলনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লায়। ঝড়ের প্রভাবে ৪.৭ থেকে ৯.১ মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় জোয়ারের পানি। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৪৬ কিলোমিটার। ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন ১৫ লাখ অধিবাসী। ৮৫০ মানুষের প্রাণহাণি ঘটে। ৬৫ হাজার গবাদিপশু মারা যায়।
১৯৭০ সালের ৭ থেকে ১৩ নভেম্বর তীব্র ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে ভোলাসহ দেশের সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলে। চট্টগ্রাম, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, চর বোরহানুদ্দিনের উত্তর পাশ, চর তাজুমুদ্দিন এবং মাইজদি ও হরিণঘাটা এর দক্ষিণ পাশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সরকারি হিসেব অনুযায়ী প্রায় পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। যার প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি ধারণা করা হয়। আনুমানিক ২০ হাজার মাছ ধরা নৌকা ধ্বংস হয়। বিনষ্ট হয় ব্যাপক পরিমাণ শস্য ও সম্পদ। প্রায় ১০ লাখ গবাদিপশু মারা যায়। চার লাখ বাড়িঘর ও সাড়ে ৩ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিধ্বস্ত হয়। ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী ওই ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২২ কিলোমিটার। এর প্রভাবে সাড়ে ১০ মিটারেরও বেশি উচ্চতায় বৃদ্ধি পায় জোয়ারের পানি।
১৯৭১ সালের ৫ থেকে ৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে আরেকটি মাঝারি ঘূর্ণিঝড়। থেমে থেমে দু দিন ধরে হওয়া ওই ঝড়ে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
