বৃহস্পতিবার   ১৪ আগস্ট ২০২৫   শ্রাবণ ২৯ ১৪৩২   ১৯ সফর ১৪৪৭

ইভাঞ্জেলিস্তা তোরিসেলি ও ব্যারোমিটারের গল্প

নিউজ ডেস্ক

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৯:১৬ পিএম, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ সোমবার

'প্রকৃতি শূন্যস্থানকে ভয় করে' মহাজ্ঞানী এরিস্টটলের একটি জনপ্রিয় উক্তি এটি। তিনি মনে করতেন মহাজগতে কোনো প্রকৃত ফাঁকা বা শূন্যস্থান নেই। যখনই কোথাও কোনো ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি হয়, তার চারপাশের কোনো বস্তু এসে শূন্যস্থানটি পূরণ করে দেয়। তার এই ধারণা পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হয়। বায়ুচাপ মাপার যন্ত্র; যাকে আমরা ব্যারোমিটার হিসেবে জানি, সেটির মূল উপাদানই হচ্ছে ভ্যাকিউম বা বায়ুশূন্য স্থান।

যাদের প্রাথমিক বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা আছে তারা নিশ্চয়ই জানেন, বায়ুচাপ পরিবেশের তাপমাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত। বায়ুর তাপমাত্রা বেড়ে গেলে তা হালকা হয়ে যায়। হালকা বায়ু অভিকর্ষের প্রভাব কাটিয়ে উপরে উঠে যায়। ফলে ওই জায়গাতে সৃষ্টি হয় সাময়িক বায়ু শূণ্যতার। এই শূণ্যতা পূরণের জন্য আশেপাশের উচ্চচাপ অঞ্চলের বায়ু এসে সেখানে জড়ো হয়ে শূন্যস্থান পূরণ করে। এখন ভাবুন তো তাপমাত্রার ওঠানামা যদি খুব দ্রুত হয় তবে কি হবে?

 

কোনো জায়গার তাপমাত্রা খুব দ্রুত বেড়ে গেলে অল্প সময়েই সেখানে নিম্নচাপের সৃষ্টি হবে। হঠাত এই নিম্নচাপের জবাবে চারপাশের অঞ্চলের শীতল বায়ুও খুব দ্রুত ওই আচমকা বায়ুশূন্য হয়ে যাওয়া এলাকায় ঢুকতে চাইবে। চারপাশ থেকে বাতাস এসে ওই এলাকায় প্রচণ্ড বল প্রয়োগ করবে। এর ফলে ওই এলাকায় সৃষ্টি হবে ঘূর্ণিঝড়, হারিকেন, টর্নেডোর মতো ভয়াবহ সব দূর্যোগের। ভয়াবহ এসব দূর্যোগের পূর্বাভাস পেতে ও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বায়ুচাপ পরিমাপের কোনো বিকল্প নেই। এ কারণেই আবহাওয়াবিদ ও বিজ্ঞানীদের প্রাত্যহিক জীবনে ব্যারোমিটার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।

ব্যারোমিটার আবিষ্কার এবং যেভাবে কাজ করে: যন্ত্রটি বহু বছরের সাধনার ফল। কারণ এরিস্টটল ও অন্যান্য দার্শনিকদের দেয়া তত্ত্ব বাইরে গিয়ে প্রাচীণপন্থিরা মানতে নারাজ ছিলেন যে, ভূপৃষ্ঠের ওপর বায়ুমণ্ডল চাপ প্রয়োগ করতে পারে! তাদের তত্ত্বকে ধ্রুব সত্য বলে বিবেচনা করা হয়েছিলো বহু বছর ধরে। যেহেতু ব্যারোমিটারের মূলনীতি এরিস্টটলের শূন্যস্থানহীনতা তত্ত্বের পরিপন্থী, তাই কেউ এ যন্ত্র আবিষ্কার নিয়ে তেমন চিন্তা ভাবনা করেনি। কিন্তু ওই যে একটা কথা আছে, প্রয়োজনীয়তাই উদ্ভাবকের জনক! একটি সঠিক বায়ুচাপ মাপার যন্ত্র আবিষ্কারের তাড়না অনুভবের পেছনে ঐ 'প্রয়োজনীয়তা' ই মুখ্য হয়ে দাড়ায়।

সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে কিছু ইতালিয়ান খনি শ্রমিক জটিল এক সমস্যায় পড়লেন। তারা দেখলেন তাদের পাম্পগুলো ১০ দশমিক ৩ মিটারের বেশি পানি তুলতে পারছে না। তখন গ্যালিলিও গ্যালিলিসহ বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী মত দিলেন, পাইপ থেকে বাতাস বের করে আনার জন্যেই পাইপের ভেতর থেকে পানি উপরে উঠতে সক্ষম হয়। কিন্তু পাম্প কর্তৃক প্রয়োগকৃত বলের সীমাবদ্ধতার কারণে তা ১০ দশমিক ৩ মিটারের বেশি উচ্চতায় পানি তুলতে পারছে না। অর্থাৎ,পানি উপরে তুলতে পাইপের ভেতরটা বায়ুশূন্য হতে হয়। এর আগে মানুষ পাম্প ব্যবহার করত ঠিকই কিন্তু এ সম্পর্কে ভাবেনি কখনো। গ্যালিলিওই ছিলেন প্রথম কেউ যিনি অ্যারিস্টটলের মতের বাইরে গিয়ে কিছু বলেন।

 

যদিও ভ্যাকিউমের ধারণা তখনও বেশ বিতর্কিত। কিন্তু গ্যালিলিওর এই প্রথাবিরোধী অভিমতে অন্য এক বিজ্ঞানী গ্যাস্পারো বারটি একটি ছোট পরীক্ষা চালান যা দ্বারা গ্যালিলিওর বক্তব্য প্রমাণিত হয়। তিনি একটি লম্বা টিউবকে পানি দিয়ে সম্পূর্ণ ভর্তি করলেন। তারপর যাতে টিউব থেকে এক ফোঁটা পানিও বাইরে না পড়ে সেজন্য টিউবের মুখে ভালো করে চেপে ধরে সেটিকে ছবির মতো করে একটি অগভীর অর্ধপূর্ণ চৌবাচ্চায় উল্টো করে বসালেন। এখন চৌবাচ্চার পানির উপরের পৃষ্ঠ টিউবটির মাথা স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে আঙুল সরিয়ে নেয়া হলো। দেখা গেলো, টিউবটি থেকে পানি চৌবাচ্চায় স্থানান্তরিত হচ্ছে যতক্ষণ না পর্যন্ত টিউবে পানির উচ্চতা ১০ দশমিক ৩ মিটার না হয়। টিউবের মাথা থেকে পানি সরে যে ফাঁকা স্থান তৈরি হলো, সেটি সত্যিকার অর্থেই 'শূন্যস্থান'। কারণ সেখানে বায়ু প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরো অনেকেই এই পরীক্ষণকে গ্যালিলিওর তত্ত্বের প্রমাণ বলে মেনে নিতে পারেন নি।

তখন এগিয়ে এলেন ইভাঞ্জেলিস্তা তোরিসেলি। তিনি ছিলেন গ্যালিলিওর একজন তরুণ ছাত্র এবং বন্ধু মানুষ। তিনি একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এক্সপেরিমেন্টটি দেখেতে চাইলেন। কিভাবে টিউবের পানির উচ্চতা বাড়ানো কমানো যেতে পারে? অবশ্যই চৌবাচ্চার পানির উপর চাপ বাড়িয়ে কমিয়ে। তো, প্রাকৃতিকভাবে এই চাপ কে দেবে? উত্তর হলো বাতাস। কিন্তু স্বয়ং গ্যালিলিওসহ প্রাচীণবাদী বিজ্ঞানীরা ধারণা পোষণ করতেন,আমাদের চারপাশের বায়ুমণ্ডলের বাতাসের ওজন নেই। তাহলে চাপ কোত্থেকে আসবে? তোরিসেলি তাদের ভ্রান্ত ধারণা ভাঙতে অযথা তর্ক করতে গেলেন না। তিনি গ্যাস্পারো বারটির পরীক্ষায় পানির বদলে ব্যবহার করলেন পারদ। পারদের ঘণত্ব যেহেতু বেশি, তাই সেটি ব্যবহারের ফলে টিউবের মধ্যে তরলের উচ্চতা আরও কমে গিয়ে শূণ্য দশমিক ৭৬ মিটারে দাঁড়ালো। তো এখন অ্যার অস্বীকার করার অবকাশ রইলো না, যে টিউবের উচ্চতা কমবেশির জন্য ওজন মুখ্য। এই ওজন যে বায়ুমণ্ডলও প্রয়োগ করতে পারে, সেটি প্রমাণ করা এখন চ্যালেঞ্জ।

 

তোরিসেলি এবার তার পরীক্ষায় আনলেন নতুনত্ব। দুটি টিউব ব্যবহার করলেন তিনি। একটি আগেরগুলোর মতো সাধারণ, অন্যটির মাথাটি গোলাকার, ঠিক চিত্রে যেমন দেখছেন। তো এখানে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী কি ঘটবার কথা? একটু মন দিয়ে ভাবুন যদি দুইটি টিউব থেকেই সমপরিমাণ পারদ নিচে নেমে আসে, তাহলে অবশ্যই গোল মাথাযুক্ত টিউবটিতে পারদের উচ্চতা বেশি হবার কথা। যুক্তিটা সিম্পল,ওই গোলাকার জায়গাটুকুতে লম্বা টিউবের থেকে বেশি পারদের স্থান সংকুলান হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো, দুইটি টিউবে ঠিক ওই ৭৬ সেন্টিমিটার উচ্চতাতে এসেই পারদের অবনমন শেষ হয়!

তোরিসেলির তত্ত্বকে তর্কের ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে সহায়তা করেন বিজ্ঞানী ব্লেইজ প্যাসকেল। তিনি তোরিসেলির অনুরূপ একটি পারদের টিউব নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে পরীক্ষাটি করলেন। তাতেই এলো সমাধান। তিনি দেখলেন, পাহাড়ের চূড়ায় পারদের উচ্চতা ৭৬ সেন্টিমিটার থেকে উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। প্যাসকেল বলেন, এর পেছনে একটি কারণ বিদ্যমান। বাতাসের ওজন আছে এবং তা বায়ুচাপেরও সৃষ্টি করে। এ কারণেই অধিক উচ্চতায় ভূপৃষ্ঠের তুলনায় বায়ুচাপ কম হওয়ার কারণে সেটি পারদের উচ্চতাও কমিয়ে দেয়। এতে আর কোনো সন্দেহ থাকলো না যে, তোরিসেলির পরীক্ষার সাহায্যেই বায়ুচাপের পার্থক্য মাপা যাবে। তোরিসেলির তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হয় বায়ুচাপ মাপার যন্ত্র ব্যারোমিটার। ২০০৭ সাল পর্যন্ত তোরিসেলির মডেলে নির্মিত ব্যারোমিটারই বায়ুচাপ মাপার যন্ত্র হিসেবে বিশ্বজুড়ে সর্বত্র ব্যবহৃত হতো।

পারদের বিষাক্ততার কথা চিন্তা করে ২০০৭ সালে সমগ্র ইউরোপে পারদের ব্যারোমিটার উৎপাদন নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। বর্তমানে তার বদলে ইকো-সেলি ব্যারোমিটার ব্যবহার করা হয়। তোরিসেলির এই ব্যারোমিটার আবিষ্কারের ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়, তা হলো- ‘থিংক আউটসাইড দ্য বক্স; অথবা বলতে পারেন, ‘থিংক আউটসাইড দ্য টিউব’!এরিস্টটল থেকে গ্যালিলিও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা মতবাদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। সবাই যখন মত দিয়েছেন ভ্যাকিউম বলতে কিছু নেই, বায়ুমণ্ডলের ওজন নেই- তিনি সেগুলো মেনে নিয়ে বসে থাকেন নি। সত্যকে জানতে পরীক্ষা চালিয়ে গেছেন। সবাই যখন টিউবের উপরের জায়গা ফাঁকা কিনা বায়ুপূর্ণ- এই তর্কে লিপ্ত তোরিসেলি তখন টিউবের বাইরের পরিবেশের কথা ভেবেছেন। তাতেই এসেছে সাফল্য। গণ্ডির বাইরে গিয়ে ভাবতে শেখা তাৎপর্যপূর্ণ! ডেইলি বাংলাদেশ/জেএমএস/এসজেড