শনিবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫   পৌষ ১২ ১৪৩২   ০৭ রজব ১৪৪৭

বনানী অগ্নিকাণ্ড

মৃত্যুকূপে ৬ ঘণ্টা

আমাদের নারায়ণগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৮:৩৪ এএম, ৩০ মার্চ ২০১৯ শনিবার

চারদিকে ধোঁয়া আর ধোঁয়া, কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। মাত্র ১০ মিনিটের ব্যবধানেই পুরো এফআর টাওয়ার আচ্ছন্ন কালো ধোঁয়ায়। সে কারণে ভবনের প্রতিটি তলা থেকে বের হয়ে আসা ছিল প্রায় অসম্ভব।

টানা ৬ ঘণ্টার বর্ণনায় উঠে এসেছে ভয়ার্ত সব মুহূর্ত। কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ২২ তলা ফারুক রূপায়ন (এফএঅর) টাওয়ারের ১৭ তলায় থেকে উদ্ধার হওয়া এক নারী ৬ ঘণ্টার অগ্নিযুদ্ধের কিছু খণ্ডচিত্র তুলে ধরেন। 

 

বৃহস্পতিবার ভবনটির ষষ্ঠ তলায় সূত্রপাত হওয়া এ ভয়াবহ আগুনে ২৫ জনের মৃত্যু হয়। অসংখ্য মানুষ আহত হন। আর সেখান থেকে কোনো রকমে জীবন নিয়ে ফেরেন সোনিয়া পারভিন (৩৯)। আমরা নেটওয়ার্কস লিমিটেডের ক্রেডিট কন্ট্রোল ম্যানেজার পারভিন জানান, আমরা ওই সময় একটা বিভাগীয় মিটিং করছিলাম। হঠাৎ জানালা দিয়ে দেখলাম কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। সবাই দৌড়ো দৌড়ি শুর করল। লক্ষ্য করলাম আমাদের ভবনেই লেগেছে আগুন। সঙ্গে সঙ্গে আমি অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে অফিস থেকে বের হয়ে সিঁড়ির কাছে যাই। সেখানে অসংখ্য মানুষের আর্তচিৎকার শুনতে পাই। কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ছিল সিঁড়িটি।

তিনি জানান, মাত্র ১০ মিনিটের ব্যবধানে পুরো ভবনটি ধোঁয়ায় ভরে যায়। আমরা ছাদে চলে যাই। প্রায় ৫০ জনের মতো আমরা ছাদে উঠতে সক্ষম হই। কিন্তু ধোঁয়ার কারণে সেখানেও বেশি সময় টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। পরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাফিয়ে পাশের ভবন আহমেদ টাওয়ারে ছাদে যান সবাই। সেখান থেকে কোনো মতে নিচে নামতে সক্ষম হন পারভিন।

 

তিনি আরো জানান, অনেককে ভবনের জানালা ভেঙে লাফ দিতে দেখেছেন। তাদের ছাদে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না বলে, জানালা ভেঙে লাফিয়ে পড়তে হয়েছে। কি হয়েছে তাদের ভাগ্যে সেটা জানেন না তিনি। তবে সেসব দৃশ্য এখনো কাঁপায় তাকে।

এফআর টাওয়ারে আগুনে আটকা পড়া মানুষগুলো দুটি উপায়ে বাঁচার চেষ্টা করেছেন- কেউ ছাদে গিয়ে আশ্রয় নেন। কেউ জানালা ভেঙে পাশের ভবন আহমেদ টাওয়ারে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

 

আগুন লাগার পর মাত্র ১৫ মিনিট পর্যন্ত ছাদে যাওয়া সম্ভব ছিল। অর্থাৎ বেলা ১২টা ৪৫ মিনিটের দিকে আগুন লাগার পর ১টার পর আর ছাদে যাওয়া সম্ভব ছিল না জানান পারভিন। তিনি বলেন, এরপর সিঁড়িতে ধোঁয়ার মাত্রা এতটাই ছিল যে আর উপরের দিকে যাওয়া সম্ভব ছিল না।

তিনি আরো জানান, তাদের ফ্লোরে ৬৫ জন কর্মী থাকলেও চারজন বের হতে পারেননি। পরে ফায়ার সার্ভিস বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটে তাদের উদ্ধার করে অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করেন।

২২ তলা এফআর টাওয়ারে প্রায় দেড় ডজনেরও বেশি বিভিন্ন অফিস থাকলেও কোনো জরুরি নির্গমন পথ ছিল না বলে দাবি পারভিনের। তিনি বলেন, এখানে প্রায় সাত বছর ধরে কাজ করছি। কয়েক বছর আগে ভূমিকম্পের সময়ও এমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল.. তখনও আতঙ্কে তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে অনেকে আহত হয়েছিলেন।

অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি আছে মরণকূপ থেকে বেচে আসা সুশান্ত রায়। তিনি ডেইলি বাংলাদেশকে জানান, স্রষ্টাকে ধন্যবাদ যে বেঁচেছি। আমি ১৭তম ফ্লোরে যখন আটকে পড়েছিলাম, তখন ভেবেছিলাম, এটাই বোধহয় শেষ… আর হয়তো বেঁচে ফিরতে পারব না…। কালো ধোঁয়া ও অক্সিজেন স্বল্পতায় শ্বাসও নেয়া যাচ্ছিল না।

 

সুশান্ত বলেন, ভবনের জানালার কাঁচগুলো ভেঙে ফেলি। সহায়তার জন্য হাত নেড়ে চিৎকার করতে থাকি। একবার ভেবেছিলাম লাফ দেব, তখনই অনেককে তার বেয়ে নিচে নামতে গিয়ে পড়ে যেতে দেখলাম। এবার পেয়ে বসলো পড়ে মরার ভয়। ভাবলাম লাফিয়ে না পড়ে এভাবেই থাকি, যদি ফায়ার কর্মীরা পৌঁছাতে পারেন, তবে তো প্রাণে বাচঁবো। ঠিক তাই। পরে সুশান্ত ফায়ার কর্মীদের সহায়তায় মই বেয়ে নামেন। কিন্তু অনেকেই তা পারেননি। ছিটকে পড়েছেন নীচে।

মেয়ে আমার আগুনের মধ্যে পুড়ছে, আর আমি নিচে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম; কিছুই করতে পারিনি! দুপুরে প্রথমে টিভিতে দেখি বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন। আমার কলিজার টুকরা যে এখানে, ১২ তলায় দারাজ গ্রুপে চাকরি করে। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকে ফোন দেই। ফোন আর বাজে না! আরেক মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে আসি বনানী। রাস্তায় লাখ লাখ মানুষের ভিড় ভেতরে ঢুকতে পারি না!

 

এভাবেই কাঁদতে কাঁদতে বনানীর এফ আর টাওয়ারের আগুনে নিখোঁজ মেয়ের বর্ণনা দিচ্ছিলেন তার মা। ওই সময় ভবনটির জ্বলন্ত ১২ তলায় অর্পা। 

অর্পার মা আরো বলেন, সময় কাটছে। অর্পা নামের কেউ বেঁচে আছে, না উদ্ধার হয়েছে? কিছুই জানি না। পরে ট্রলিটি যখন বিকেল ৪টার দিকে উপরে ওঠে তখন জানতে পারি, অর্পা নামের একজন আছে। তারা জানায়, পরের বার উঠে নামানো হবে তাকে। এর মধ্যে আধা ঘণ্টা কেটে গেলো। দেখি, আগুন আরো বাড়ছে। কলিজা ফেটে চিৎকার করে উঠি, এই বুঝি শেষ। একটা মেশিন ১২ তলায় উঠতে এতো সময় লাগে? অর্পা আর নেই। চিৎকার করতে থাকি, আর দোয়া পড়ি।

এভাবেই উৎকণ্ঠার মধ্যে কেটে গেলো কয়েক ঘণ্টা। বিকেল সাড়ে চারটার পর অর্পাকে অক্ষত নামালো উদ্ধার কর্মীরা। পরে উপলব্ধি করলাম, উদ্ধার কর্মীদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় আমার মেয়েকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে পেলাম। 

এক তরুণীকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনেন ফায়ার কর্মী। এক ফায়ার যোদ্ধার পিঠের ওপর চড়ে জীবনমৃত্যুর দুয়ার ছুঁয়ে এলেন তিনি। মৃত্যুর কতটা কাছ থেকে ফিরলেন তা বোঝা যায় তার কান্নায়। বেঁচে গেছেন তবুও ফেলে আসা আতঙ্ক তখনও ভাসছে তার চোখেমুখে। ভয়ার্ত মুখে কাঁদছেন তিনি।

অগ্নিযোদ্ধা যারা নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে অন্যের জীবন বাঁচাতে একটুও পিছ পা হন না। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) খন্দকার আবদুল জলিল। তিনি জানান, তখন তিনটি ল্যাডার ইউনিট দিয়ে আগুন নেভানো হচ্ছিল। ওই তিনটির মধ্যে একটি ল্যাডার ইউনিটে নিয়ে যখন ১২ বা ১৩ তলায় পৌঁছান, তখন একটি মেয়ে বাঁচান-বাঁচান বলে কাঁদছিল। আমরা তাকে কিছুটা আগাতে বলি, সে জানায় হাঁটতে পারছেন না, তার পায়ে আঘাত রয়েছে। সে শুধু একটি কথাই বলছিল ‘আমার মা নিচে, মায়ের কাছে যাব।’

উপায় অন্তর না দেখে, ঝুঁকি নিয়ে ল্যাডার থেকে লাফিয়ে ভেতরে যান জলিল। বাঁচাতে হবে মেয়েটিকে। আগুনের তাপ ছুঁয়ে দৌড়ে গিয়ে ওই তরুণীকে নিজের কাঁধে তুলে নেন আব্দুল জলিল। এ সময় সে খুব কান্নাকাটি করছিল। আমি তাকে হালকা করার জন্য জিজ্ঞাসা করি, কী করেন? সে জানায় চাকরি। এরপর তার বাবা-মায়ের নাম জিজ্ঞাসা করলে সে বলে, আমার মা নিচে আছে।

ভয়াবহ আগুনে আটকা পড়া অনেকেই বাঁচার আকুতি জানিয়ে তাৎক্ষনিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লাইভ করছেন। এমন একটি লাইভ করেছিলেন সেজুতি স্বর্ণা। লাইভ ভিডিওতে, সিড়ির জন্য আকুতি জানান তিনি এবং তার সঙ্গীরা। না হয় বাঁচতে পারবেন না।

এমন অজস্র ঘটনার জন্ম দিয়েছেন বনানীর আগুন স্পর্শ মৃত্যুকূপের আহতরা। নিহতদেরও আছে লোমহর্ষক স্মৃতি।

 

আগুন নিভে গেছে, সেই সঙ্গে নিভে গেছে অনেক তাজা প্রাণ। ভস্মীভূত হয়েছে শতাধিক পরিবারের অগণিত স্বপ্ন। দেশবাসী দেখেছেন বীর সেনাদের বীরত্ব। হয়তো অনেকেই পুরস্কৃত বা তিরস্কৃত হবেন। কিন্তু জীবন্ত মানুষের পুড়ে মরার নারকীয় দৃশ্যের শেষ হবে কবে?