ওয়ালশ-রফিককে অনুসরণ না করে এ কি ঘটনা ঘটালেন অশ্বিন?
আমাদের নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশিত : ০৩:১৮ পিএম, ২৬ মার্চ ২০১৯ মঙ্গলবার

এ কি করলেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন? ক্রিকেট যে শুধু খেলাই নয়, ভব্যতা-সৌজন্যতা ও শিষ্টাচারেরও অনুপম ক্ষেত্র, ম্যাচ জয়ের নেশায় তা কি বেমালুম ভুলে গেছেন এ ভারতীয় নামী ক্রিকেটার? ম্যাচ জিততে এক অখেলোয়াড়সুলভ ঘটনার জন্ম দিয়ে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ও রীতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে ফেললেন কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের এ অফস্পিনার।
গতকাল ২৫ মার্চ সোমবার রাতে জয়পুরে রাজস্থান রয়্যালসের বিপক্ষে অশ্বিন যা করলেন, তা কিন্তু ক্রিকেটীয় নিয়ম-নীতির বাইরে নয়। ক্রিকেটে পরিষ্কার নিয়ম আছে, বোলার রান আপ শুরুর পর যদি দেখে ননস্ট্রাইকার সিঙ্গেলস বা এক রানের জন্য আগেই পপিং ক্রিজ (বোলিং প্রান্তে সাদা দাগের ভিতরের নির্ধারিত জায়গা) ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেছেন, তখন বোলার ডেলিভারি না দিয়ে, মানে বল না ছুঁড়ে বেলস তুলে নিলে কিংবা বল দিয়ে উইকেট ভেঙে ফেললে ঐ ননস্ট্রাইকার রান আউট হবেন। ক্রিকেট ব্যাকরণ তথা ক্রিকেট অভিধান-সংষ্কৃতিতে যাকে বলা হয় ‘ম্যানকাড’।
এমন নয় ক্রিকেটে এমন ম্যানকাড আউটের নজির নেই। কিংবা ক্রিকেটে কখনো কেউ এভাবে আউট হননি বা কোন বোলার অমন করে কাউকে আউট করেননি। পাড়া-গলির ক্রিকেটে হরহামেশাই হতো। আর জাতীয় পর্যায়ের ক্রিকেটে এমনকি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও এক সময় এভাবে ম্যাচ জিততে মরিয়া কোনো কোনো বোলার এভাবে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে আউট করেছেন।
কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে বিশেষ করে ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তাননের সেমিফাইনাল নির্ধারনী ম্যাচের পর থেকে গত প্রায় তিন যুগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমন ঘটনা ঘটেনি বললেই চলে।
আজকাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তো নয়ই, কোন প্রথম শ্রেণি, লিস্ট ‘এ’ এমনকি পাড়া-গলির ক্রিকেটেও এভাবে কেউ কাউকে আউট করেন না। যেমন করেন না হ্যান্ডলড দ্যা বলের আবেদন। ক্রিকেটে নিয়ম আছে, বল ডেড হবার আগে ব্যাটসম্যান বল ধরে ফেললে ফিল্ডাররা আবেদন করলে, আউট। সেটা ‘হ্যান্ডল দ্যা বলের’ আওতায় পড়ে যায়।
অর্থাৎ, ক্রিকেটে যত রকমের আউট আছে, ম্যানকাডের মত সেটাও এক রকম আউট। বল ডেড হওয়ার আগে, মানে কোন ফিল্ডারের হাতে যাবার আগে মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় ব্যাটসম্যান তা হাতে ধরে কোন ফিল্ডারের হাতে জমা দিলে ফিল্ডার আবেদন করলে আউট বলে গণ্য হতেন, হবেনও।
তবে এখন আর কেউ তা করেন না। আজকাল হরহামেশা দেখা যায় উইকেটকিপার উইকেটের অন্তত ১২-১৪ গজ দুরে গ্লাভস হাতে দাঁড়িয়ে, স্লিপ, গালি কিংবা কাছাকাছি বা ক্লোজ ইন ফিল্ডিং পজিশনে কেউ নেই। ব্যাটসম্যান তখন ডিফেন্স করা বল মাটি থেকে তুলে ফিল্ডারের কাছে অহরহ তুলে দিচ্ছেন। কেউ আর ‘হাউ ওয়াজ দ্যাট’ বলে আবেদন করছেন না। এটা নিয়মের মধ্যে থেকেও এখন অলিখিত অনিয়মে পরিণত হয়েছে। এখন শিষ্টাচারের বাইরে চলে গেছে।
সেখানে ম্যানকাডে কাউকে আউট! রীতিমত দূর্লভ ঘটনা বলেই পরিগনিত। অথচ কাল তাই করেছেন অশ্বিনের মত নামী ও নন্দিত ক্রিকেটার। বলার অপেক্ষা রাখে না, ক্লোজ ম্যাচ জিততেই এ কাজটি করেছেন কিংস অফ পাঞ্জাব অধিনায়ক অশ্বিন।
অথচ ইতিহাস জানাচ্ছে এর আগে গত ৩২ বছরে অন্তত দুই দু’বার এমন পরিস্থিতিতে প্রতিপক্ষ নন স্ট্রাইকারকে আউট না করে উল্টো নন্দিত ও প্রশংসিত হয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোর্টনি ওয়ালশ আর বাংলাদেশের মোহাম্মদ রফিক।
সেটা ছিল ১৯৮৭ সালের ১৬ অক্টোবরের ঘটনা। লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের সাথে গ্রুপ পর্বের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে শেষ ওভারে গিয়ে হার মেনেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শেষ ওভারে পাকিস্তানের দরকার ছিল ১৪ রানের। বোলার ছিলেন তখনকার ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফাস্ট বোলার কোর্টনি ওয়ালশ। উইকেটে ছিলেন পাকিস্তানি লেগস্পিনার আব্দুল কাদির ও ফাস্ট বোলার সেলিম জাফর।
শেষ ওভারে স্ট্রাইকে ছিলেন আব্দুল কাদির। নন স্ট্রাইকার ছিলেন সেলিম জাফর। একবার ওয়ালশ বল করার আগে দৌড় শুরুর পর দেখলেন সেলিম জাফর সিঙ্গেলসের জন্য ননস্ট্রাইক এন্ড বা ক্রিজ ছেড়ে দু' পা বেরিয়ে গেছেন। ওয়ালশ তাকে আউট করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে উল্টো জাফরকে সতর্ক করে দেন, ‘শোন হে, আমি কিন্তু তোমাকে আউট করতে পারতাম। নিয়ম অনুযায়ী আমি বেলস তুলে নিলে বা উইকেট ভেঙে দিলে তুমি আউট। কিন্তু আমি তা করলাম না।’
সে ঘটনার পর ক্যারিবীয়দের টপকে বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে পৌছে যায় পাকিস্তান। আর ১৯৭৫-১৯৭৯ সালের বিশ্বকাপ বিজয়ী এবং ১৯৮৩ সালের রানার্সআপ ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপের চতুর্থ আসরে এসে প্রথমবার বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল না খেলে বিদায় নেয়। অথচ সেলিম জাফরকে আউট করলেই ক্যারিবীয়রা উল্টো পাকিস্তানকে পিছনে ফেলে চলে যেতে পারতো সেমিফাইনালে। কিন্তু ওয়ালশ তা করেননি। ঐ ওভার তথা খেলার ১০০ নম্বর ওভারে ওয়ালশকে ছক্কা হাঁকিয়ে পাকিস্তানকে জিতিয়ে দেন কাদির।
কেন ওয়ালশকে কাদিরের সঙ্গী সেলিম জাফরকে বাগে পেয়ে এবং নিয়ম ও আইনের ভেতরে থেকেও আউট করেননি? দল বিশ্বকাপের মত মহা আসরের সেমিফাইনাল খেলবে, তা জেনে বুঝেও কেন সেদিন সেলিম জাফরকে ম্যানকাডের ফাঁদে ফেলেননি ওয়ালশ? তার কি মাথায় ছিল না, সেলিম জাফরকে আউট করা মানেই পাকিস্তান অলআউট, আমরা আবার সেমিফাইনালে। তারপরও কেন ঐ ক্যারিবীয়ান সেদিন অমন ঘটনার জন্ম দেননি? তা না করে ওয়ালশ কি সমালোচিত বা নিন্দিত হয়েছিলেন?
নাহ! একটুও না। বরং ‘ভদ্রলোকের খেলা বা জেন্টলম্যান গেম’ ক্রিকেটে শেষ অবধি শিষ্টাচার, নম্রতা, ভদ্রতা যে জয় পরাজয়ের চেয়ে বড়, তার নজির দেখিয়ে বিশ্বের কোটি ক্রিকেট অনুরাগির অকুন্ঠ প্রশংসা কুড়িয়ে ছিলেন ওয়ালশ। ধন্য-ধন্য সাড়া পড়ে গিয়েছিল সর্বত্র। ওয়ালশ হয়েছিলেন দারুণভাবে নন্দিত, প্রশংসিত।
সেটাই শেষ নয়। ২০০৩ সালে টেস্টে প্রায় একই ঘটনার জন্ম দিয়ে সবার মন জয় করেছিলেন বাংলাদেশের বাঁহাতি স্পিনার মোহাম্মদ রফিক। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তিন টেস্টের সিরিজের শেষ ম্যাচের শেষ ঘণ্টার ঘটনা। সময় কাল ২০০৩ সালের ৩ থেকে ৬ সেপ্টেম্বর।
পাকিস্তানের মুলতানে ইনজামাম উল হকের পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়ের হাতছানি ছিল বাংলাদেশের সামনে। পাকিস্তানের নবম উইকেট জুটিতে তখনকার পাকিস্তান অধিনায়ক ইনজামাম উল হকের সঙ্গী ছিলেন ফাস্ট বোলার ওমর গুল।
পাকিস্তানের জয়ের নায়ক ও ঐ সিরিজের ক্যাপ্টেন ইনজামাজাম উল হকের সঙ্গী ফাস্ট বোলার ওমর গুলকে আউট করার সুযোগ পেয়েও করেননি বাংলাদেশের বাঁহাতি স্পিনার মোহাম্মদ রফিক। ম্যাচের এক পর্যায়ে মোহাম্মদ রফিকের কোন এক ওভারের শেষ বলে প্রান্ত বদলের জন্য ননস্ট্রাইকার ওমর গুল বোলিংয়ের আগেই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।
রফিক তাকে আউট না করে মৌখিক ভাবে সতর্ক করে দেন, ‘এই যে তুমি কিন্তু ক্রিজের বাইরে। আমি ইচ্ছে করলে আউট করতে পারতাম। কিন্তু ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটে এখন আর কেউ এভাবে কাউকে আউট করে না। তাই অমিও করলাম না।’
ইনজামামের সঙ্গে ৫২ রানের পার্টনারশিপে গুলের অবদান ছিল মোটে ৫। ঐ রান করার আগে একবার ম্যানকাড আউটের হাত থেকে বেঁচে যান গুল। ননস্ট্রাইকার গুলকে আউট করার সযোগ পেয়েও করেননি বাঁহাতি স্পিনার রফিক। বলার অপেক্ষা রাখে না, শেষ পর্যন্ত ১ উইকেটের ন্যুনতম ব্যবধানে হার মানে বাংলাদেশ।
ওপরের ঘটনা দুটি পরিস্কার বলে দিচ্ছে ওয়ালশ আর রফিক দল জেতানোর অভিপ্রায় থেকে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে আউট করার সুযোগ পেয়েও ম্যানকাড করেননি। কারণ একটাই- বিষয়টা চোখে লাগে। দৃষ্টিকটু এবং ক্রিকেটীয় ভদ্রতা, ভব্যতা, সৌজন্যতা ও শিষ্টাচারের সাথে যায় না।
দুঃখজনক হলেও সত্য কাল (সোমবার) রাতে রবিচন্দ্রন অশ্বিন সে দীর্ঘদিনের রীতি ও শিষ্টাচার ভেঙে দৃষ্টিকটুভাবে ইংলিশ ব্যাটসম্যান বাটলারকে আউট করলেন। আরও দুঃখজনক, তিনি খেলা শেষে নিজের করা কাজের পক্ষে সাফাইও গাইলেন। এছাড়াও কেউ কেউ এটাকে শিষ্টাচার এবং ক্রিকেটীয় রীতি ও সৌজন্যতার বরখেলাপের চেয়ে ক্রিকেটের নিয়মের অংশ বলে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টায় রত।
তাদের উদ্দেশ্যে একটাই কথা, বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলা আর প্রথম টেস্ট জয়ের চেয়েও কি কালকের ম্যাচ জেতা বড় ঘটনা? বড় কৃতিত্ব বা অবিস্মরনীয় সাফল্য বলে গণ্য হবে? আর তা যদি না হবে, তাহলে কেন ৩২ বছর আগে ওয়ালশ আর ১৬ বছর আগে মোহাম্মদ রফিক ম্যানকাড করার সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগাননি?
আসলে ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা। যেখানে জয় পরাজয় ছাপিয়ে ভদ্রতা, সৌজন্যতা আর শিষ্টাচার অনেক বড়। তবে কি এই ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের প্রকৃত সৌন্দর্য্য আর গৌরব কেড়ে নিচ্ছে? রবিচন্দ্রন অশ্বিনের এ আচরণ ও ঘটনা কি বার্তা দিচ্ছে?
ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট তাহলে বিশ্বকাপ ও টেস্টে বাইরে অন্য রকম ক্রিকেট! যেখানে ক্রিকেটীয় আচার, আচরণ, রীতিনীতি, ভদ্রতা, সৌজন্যতা ও শিষ্টাচার ছাপিয়ে চার-ছক্কার অবাধ প্রদর্শনী, মারমার কাটকাট ক্রিকেট আর বিপণন-বাণিজ্য ও বিনোদনটাই বড়।
আর যে কোন ভাবে জেতাটাও মুখ্য? এরপর কি তাহলে বিগ ব্যাশ আর বাংলাদেশের বিপিএল, সিপিএল, পিএসএলসহ সব ফ্র্যাঞ্চাইজি আসরে এমন ঘটবে? যদি তাই ঘটে, তাহলে যে অচিরেই ক্রিকেট তার চিরায়ত সৌন্দর্য্য ও ঐতিহ্য হারাবে, তাতে সন্দেহ নেই।